Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped


অর্জন সমূহ

জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের অবদান

গ্যাস, তেল ও খনিজের মতোই মাছ আমাদের দেশে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তাই প্রবাদেও বলা আছে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। জনবহুল বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতি, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটাতে ও অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে মৎস্য খাত বিগত কয়েক দশক যাবত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। মাছচাষি, মৎস্য বিজ্ঞানী ও গবেষক এবং সম্প্রসারণবিদসহ সংশ্লিষ্ট সবার নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আজ মৎস্য সম্পদে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। ফলে বর্তমানে দেশের মানুষ গড়ে জনপ্রতি প্রতিদিন ৬০ গ্রাম চাহিদার বিপরীতে ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম মাছ গ্রহণ করছে।

বৈশ্বিক করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে দেশের প্রায় সকল ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যাহত হলেও মৎস্য সেক্টরে এর প্রভাব পড়েনি। এর ফলস্বরূপ দেখা যায়, কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্ববাজারে আর্থিক মন্দাবস্থা থাকা সত্ত্বেও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের ফলে সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৪ হাজার ৪২ দশমিক ৬৭ মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে ৫ হাজার ১৯১ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা আয় হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে শতকরা ২৬ দশমিক ৯৬ ভাগ বেশি।২০১৯-২০ অর্থবছরে টাকার অংকে মৎস্য উপখাত থেকে জিডিপিতে যুক্ত হয়েছে ৮২ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৭৪ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। এই খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ১০ শতাংশ।

বাংলাদেশের সামগ্রিক কৃষি সেক্টরে মৎস্য খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। এক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত থাকার ফলে মাছ উৎপাদন নিয়মিত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব পরিম-লে মাছ উৎপাদনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় রেকর্ড তৈরি করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশ আজ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে বিশ্বে ৩য়, স্বাদুপানির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির হারে ২য়, বদ্ধ জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে ৫ম, অ্যাকোয়াকালচার, অর্থাৎ মাছের সঙ্গে অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ উৎপাদনে ৫ম, ইলিশ আহরণে বিশ্বে ১ম, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় ক্রাস্টাশিয়া এবং ফিনফিস উৎপাদনে যথাক্রমে ৮ম ও ১২তম। তাছাড়া তেলাপিয়া মাছ উৎপাদনে বিশ্বে ৪র্থ এবং এশিয়ায় ৩য় (অ.স ২০২২)। মাছের সম্ভাবনাময় উজ্জ¦ল ভবিষ্যৎতের কথা ভেবে এজন্যই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ থেকে ৫০ বছর আগে ১৯৭২ সালে কুমিল্লার এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘মাছ হবে দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ’।

বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ আজ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বেকারত্ব দূর করে দেশের অর্থনীতিকে আরো চাঙ্গা করতে এবং বর্তমান সরকারের আমার গ্রাম, আমার শহর এর কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার ‘দক্ষিণ বিশিউড়া’ ও শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ‘হালইসার’ গ্রামকে ‘ফিশার ভিলেজ’ বা ‘মৎস্য গ্রাম’ ঘোষণা করেছে। এছাড়া সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিসারিজ প্রজেক্ট ইন বাংলাদেশ প্রকল্পের আওতায় প্রকল্প এলাকায় ১০০টি মডেল ভিলেজ প্রতিষ্ঠা ও ৪৫০টি মৎস্যজীবী গ্রাম উন্নয়ন করা হচ্ছে। পাশাপাশি মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির বাজার সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের জন্য মান নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। গ্রামীন মৎস্য চাষি ও জেলেদের তথ্যপ্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে দেশব্যাপী জেলে নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান এবং ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলমান রয়েছে।

ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। এটিও দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ এখন ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে রোল মডেল। বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে; বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে ২০০৮-২০০৯ সালে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার মেট্রিক টন, যা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ২০২১-২২ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে ৫ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ গত ১৩ বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে শতকরা প্রায় ৮৬ ভাগ। এছাড়া গত ২০১৬ সালে ইলিশ বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ইলিশের স্বত্ব এখন শুধুই বাংলাদেশের। এটা জাতির জন্য গৌরবের। দেশে মৎস্য উৎপাদনে ইলিশ মাছের অবদান শতকরা ১২ দশমিক ২২ ভাগ। যার বর্তমান বাজার মূল্য ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। জিডিপিতে ইলিশ মাছের অবদান বর্তমানে শতকরা ১ ভাগ। ইলিশ উৎপাদনের সাথে দেশের ৫ লক্ষ লোক সরাসরি এবং ২০-২৫ লক্ষ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।

বাংলাদেশ পানিসম্পদে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য পুকুর-দিঘি, ডোবা-নালা, নদ-নদী, খাল-বিল ও বাঁওড়। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলজুড়ে রয়েছে বিশাল হাওর এলাকা যা আমাদের মৎস্য সম্পদের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে ৩ দশমিক ০৫ লক্ষ হেক্টর আয়তনের প্রায় ১৩ লক্ষ পুকুর-দিঘি রয়েছে। দেশের ২৪ হাজার কিমি. দীর্ঘ নদ-নদীর আয়তন প্রায় ১০ দশমিক ৩২ লক্ষ হেক্টর। এ ছাড়া রয়েছে ১ দশমিক ১৪ লক্ষ হেক্টর জলায়তনের প্রায় ১১ হাজার বিল, ৫ হাজার ৪৮৮ হেক্টর আয়তনের বাঁওড়, ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর কাপ্তাই হ্রদ, প্রায় ২.০০ লক্ষ হেক্টর সুন্দরবন খাঁড়ি অঞ্চল এবং ২৮ দশমিক ৩০ লক্ষ হেক্টরের বিশাল প্লাবনভূমি (ম.অ.২০২০)। এসব ক্ষেত্রে মানুষ সারা বছরই কোন না কোনোভাবে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে এবং আমিষের চাহিদা পূরণ করছে। পাশাপাশি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, বিশ্বজুড়ে মানুষের মাছ খাওয়া বেড়েছে ১২২ শতাংশ। বর্তমানে বিশ্বের সাতটি দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের অর্ধেকের বেশি আসে মাছ থেকে। বাংলাদেশে প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৫৮ শতাংশ আসে মাছ থেকে। আর বিশ্বে গড়ে প্রাণিজ আমিষের শতকরা ২০ শতাংশ আসে কেবল মাত্র মাছ থেকে। এদিকে গত ১০ বছরে দেশে মাথাপিছু মাছ খাওয়ার পরিমাণ প্রায় শতভাগ বেড়েছে বাংলাদেশে সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন মূলত আহরণ নির্ভর। উপকূলব্যাপী ৭১০ কিমি. দীর্ঘ তটরেখা থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত ১ দশমিক ৬৬ লক্ষ বর্গ কিমি. বিস্তৃত বিশাল সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসম্পদে ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি এবং ৪৭৫ প্রজাতির মাছ রয়েছে। বর্তমানে বঙ্গোপসাগর হতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রল ফিশিং এবং আর্টিসেনাল মৎস্য আহরণের মাধ্যমে মোট ৪ দশমিক ৩৯ লক্ষ মে. টন মৎস্য আহরণ করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ মৎস্য সম্পদের ন্যায় সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মৎস্যজীবীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক নৌযানে মৎস্য আহরণে নিয়োজিত প্রায় ২ দশমিক ৭০ লক্ষ মৎস্যজীবীর পরিবারের ন্যূনতম ১৩ দশমিক ৫০ লক্ষ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে উপকূলীয় সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের মাধ্যমে।

এছাড়া মৎস্য খাতে চিংড়ি বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য। সম্প্রতি বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এতে করে এটি বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের পরিচিতি বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্মৃদ্ধি নিয়ে আসবে। মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করা হয়, ২ হাজার ৭ শত ৩০ দশমিক ৫৬ কোটি টাকার। তাই বলা যায়, সম্ভাবনাময় এ খাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি দেশের কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।

মাছ শুধু খাবার ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক অবদান রেখে চলছে। মাছের চর্বি, কাটা ও হাড় ইত্যাদি জৈবসার, ঔষধ, সাবান, ছাপার কালি, আঠা প্রভৃতি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া মাছের আঁইশ, হাড়, দাঁত, ইত্যাদি দিয়ে কুটির শিল্প জাত সৌখিন দ্রব্য তৈরি করা হয়। এছাড়াও মাছের আঁইশ, কাটা, নাড়ি-ভুড়ি চূর্ণ হাঁস-মুরগির সুষম খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এসব শিল্পের মাধ্যেমে একদিকে যেমন কর্মসংস্থান হচ্ছে অন্যদিকে অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা।

বাংলাদেশে মাছ চাষের যে সম্ভাবনা রয়েছে তাকে কাজে লাগিয়ে মাছচাষ জোরদার করতে পারলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ হতে সাধারণত আইকিউএফ, কুকড, ফিস ফিলেট ইত্যাদি ভ্যালু অ্যাডেড মৎস্যপণ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশসমূহ- যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, রাশিয়া, চীনসহ বিশ্বের ৫০টির অধিক দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। রপ্তানিকৃত মৎস্য সম্পদের মধ্যে চিংড়ি, শুঁটকি মাছ, কাঁকড়া, কুচিয়া ও ব্যাঙ ইত্যাদি রয়েছে। তাছাড়া আমাদের দেশীয় রেস্টুরেন্টগুলোতে মাছের বিভিন্ন ফুড আইটেম বিক্রি হচ্ছে। ফিশ ফিঙ্গার, ফিশ বল, সল্টেড প্রোন, প্রোন বল, ফিস পাউডার, ফিস নুডুলস ইত্যাদির চাহিদা মানুষের মাঝে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন এসব শিল্পের সাথে জনবল যুক্ত হয়ে বেকারত্ব হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিতেও মাছের অবদান আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে গণভবন লেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মাছের পোনা অবমুক্ত করে মৎস্য চাষকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেয়ার শুভ সূচনা করেছিলেন। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে মৎস্যবান্ধব বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের ফলে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন আজ সফল হয়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন দেশ আজ মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায় সাধারণ মানুষ স্বল্পমূল্যে মাছ ও পুষ্টি পাচ্ছে, অন্যদিকে দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূর হচ্ছে।